সুযোগ পেলেই মানুষ হবে!

নাসিমা, আমাদের বোন। আ-মা-দে-র সবার!
ও দেখে আমাদের সবার চোখের আলোয়…

নাসিমার পরিবার আমরাই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েটা, এই শহরে যার কেউ ছিলনা। আমি কিছু হতে না হতেও আব্বুকে ফোন দেই, আমার সব সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব তো তার ই! একটু ব্যাস্ততা দেখালেই অভিমান কত আমার! আরো অনেক সহায়হীন মানুষের মত নাসিমার এই সুযোগটা নেই। একাকী এই কঠিন শহরে পথ চলে ও… … অনেক মানুষের আবেগে আর ভালোবাসায়! ওকে আগলে রেখেছে জাহান! এতোদূর নিয়ে এসেছে … … মনের জোর দিয়ে, কারণ জাহান ও এমনি ভাবেই দাড়াচ্ছে, আলোর প্রবেশ ওর চোখেও রুদ্ধ! কিন্তু মন ভীষন ভাবে আলোকিত! সে আলোর শক্তি মাপার যন্ত্রই নেই!
তারপর … …
নাসিমাকে চিনি কলেজ থেকে … … একদিন সারাদিন হাত ধরে দুইজন দাঁড়িয়ে ছিলাম … … … ওর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার অনুমতির ব্যাপার নিয়ে ……
তারপর … …
পরিবারের অনেক বাঁধা, আমাদের অসংখ্য ফোন কল, অনুরোধ , আর ওর মামার সাহায্যে ও ঢাকায় আসতে পেরেছিল রেসাল্ট দেবার পর। তার আগে না কারণ, আস্থা ছিলনা পরিবারের তাদের অন্ধ মেয়েটির প্রতি যদিও সে সবার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে … …
ব্যাপ্টিস্ট মিশন এ থাকার ব্যাবস্থা করা হলো। সাহায্যরে জন্য ব্যাঙ্ক একাউন্ট করা হলো, সেখানেও একজন সাহায্য করলেন। অন্ধ একজন এর জন্য ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলার ব্যাবস্থা নেই … … তারপরো ওকে নিয়ে যাবার পরএকজন দৃষ্টিসম্পন্ন্য ব্যক্তি ব্যাঙ্কে খোলা গেল একাউন্ট।

তারপর … ...

জাহান,সিমি, নর্থ সাউথের মারিয়া, বুয়েটের তারিন … ঢাকা ইউনির তাহিরা … … আরো কিছু আপুর সহায়তার ও পড়লো পরীক্ষার জন্য।
সিমি ওকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলো, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিতে, টিচার্স ট্রেনিং এর অনুমতি নিতে, কাগজপত্র ঠিক করতে … … ওর মামী সাহায্য করলেন অনেক।
হলিক্রসের তাম্মিম অসাধারণ সাহায্য করলো, ওর পরীক্ষার রাইটার হলো। কলেজ থেকে প্রত্যয়ন যোগার করলো।
রাইটারের অনুমতি আনতে গাযিপুর যেতে হলো, হটাত করে জানা গেল এটা ছাড়া হলে ঢুকতে পারবেনা তাম্মিম। আমাদের বাসার কেয়ারটেকার বাচ্চু চাচা ১০ মিনিটের নোটিশে পরীক্ষার আগেরদিন গাযিপুর এ গিয়ে কাগজ নিয়ে আসলেন।
সিমি ওকে নিয়ে গেল, তাম্মিম রাইটার হলো।
নাসিমা ভর্তী পরীক্ষায় চব্বিশতম হলো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে হয়ত প্রথম কোন অন্ধ মেয়ে … যেখানে আমি শুধু পাস নাম্বার চাচ্ছিলাম, কোটায় যেন ভর্তী করানো যায় ! কিন্তু আল্লাহ চাইলে কি না হয়, যখন মানুষ চেষ্টাও করে?!

তারপর … …

টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রথম বারের মত ভর্তী হলো কোন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। খুব দ্রুত ওর ভর্তীর কাজ হলো নাম না জানা একজন অফিস সহকারীর সাহায্যে,অনেক কৃতজ্ঞ আমরা ওনার কাছে!

ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে এসে এসে ক্লাস করে নাসিমা, নদী নামে একজন ওর সাথে থেকে ওকে সাহায্য করে।
প্রথম বর্ষে কেউ সিট পায়না… কিন্তু হোস্টেল সুপারভাইসারের সাথে কথা বলার পর হলে বিশেষ বিবেচনায় সিট পেলো ও।
মারিয়া আর নর্থ সাউথের তওসিফ ওকে গিয়ে মিরপুর থেকে নিয়ে আসলো ,নাবিলা গাড়ি দিল।
প্রতিমুহুর্তে ওর অদৃশ্য শক্তি হয়ে থাকে জাহান। মারিয়া ওর লোকাল গার্জিয়ানের মত এখন। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, ক্যাসেট রেকোর্ডার , রেডিও, খাবার, পোষাক… …

একা চলতে গেলেই কত বিপদ। সেই বিপদে আল্লাহই ওকে সাহায্য করেন …… এইতো সেদিন কোন এক কাজে বাইরে বের হয়েছে একাই, হাতে শাদা ছড়ি। তারপরো অগোছালো নগরীতে শঙ্কিত পায়ে সতর্ক থাকার পরও এক্সিডেন্ট করে বসলো। পা কেটে ফেললো। ব্যাথা পেল ড্রেনে পরে গিয়ে। ফোন পেয়ে তক্ষুনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সিমি আর ফারিয়া ওকে নিয়ে গেল পঙ্গু হসপিটালে। ছোট খাট কোন একটা সার্জারীর জন্য তিনঘন্টা বসে থাকতে হলো। ঘুষ ছাড়া কাজ হয়না, সরকারী হাসপাতাল … … অনেক ঝামেলা করে অবশেষে ব্যান্ডেজ করা হলো, তারপর সন্ধায় পৌছে দিয়ে আসলো হোস্টেলে, সাহায্য করলো জামিল।
একসপ্তাহ পর ড্রেসিং, কালকে ড্রেসিং করাতে নিয়ে যাবে ব্র্যাক ইউনির যুবায়ের। সাথে থাকবে মৌরিন।
কিছু অপ্রকাশিত ভালো মানুষের ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট … …
কিছু প্রকাশিত ভালো মানুষের চোখ হয়ে যাওয়া … …
কিছু অজানা ভালো মানুষের ছোট ছোট সাহায্য, বড় কিছুর জন্য … …
আর আমাদের সবার ভালোবাসা … …

এই সব কিছু মিলে নাসিমার পরিবার। হয়তো কিছু নাম বাদ পরে গেল … …

শিখতে ওদের কোন দ্বিধা নেইজানতে ওদের কোন অনাগ্রহ নেইকাজ করতে ওদের কোন অনীহা নেই ,শুধু যদি ওদের কাছে গিয়ে বলা যায়ঃ শোন ,আমি তোমার চোখ হব !!

এতোগুলো মানুষ, কেউ কাউকে চিনতোনা পরস্পর। কিন্তু সবাই এই পরিবারে সদস্য। শুদ্ধ আবগের বন্ধনে এক হয়েছে সবাই, একজন কে উপলক্ষ্য করে! কী শক্তি নাসিমার! এক অদৃশ্য নেটওয়ার্ক তৈরী করেছে ও! কিছু মানুষের পাশে থাকার আকূলতা থেকে তৈরী হওয়া এই নেটওয়ার্ক ডিজুস নেটওয়ার্কেরচেও অনেক বেশী শক্তিশালী। ভালো কাজে এক হয়েছে সবাই … … … একজনের জন্য, স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে আর একজনকে সুযোগ করে দিতে, যেন মানুষ হয় ও … … … শক্ত পায়ে দাঁড়ায় সমাজের আর দশজনের সাথে, একি অধিকারে!

Color of Paradise

 

সবাই মিলে একজোড়া চোখ!

 

কি অসম্ভব ভালো একটা ব্যাপার তাইনা, ভাবলেই ভালো লাগতে থাকে … …
কত আলোর বিচ্ছুরণ নাসিমার চোখে খেলে…

 

 

 

 

১৭ মে, ২০১০

About Sohaila Ridwan

Sohaila did Masters in Theoretical Physics and Bachelors in Physics from University of Dhaka. One founder and General Secretary at CommunityAction. E-mail: sohaila@ca-bd.org
This entry was posted in Action: Guardians in the dark, CommunityAction. Bookmark the permalink.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *