‘অ্যাকশন: পিঁয়াজু-বেগুনী’ এর শুরু ২০০৯ সাল থেকে। ‘কমিউনিটিঅ্যাকশন’এর এই উদ্যোগটি প্রথম বছর থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০০৯ এর ৪ঠা থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর অ্যাকশনিয়াররা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থাণে ১০০০ এরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে, বিশেষ করে কর্মরত পথ-শিশুদের মাঝে, ইফতার বিতরণ করে। ২০১০ সালে উদ্যোগটি আরো বড় হয় এবং উপকৃত হয় ৩৩০০ জন। আর ২০১১, মাত্র ২৪ দিনেই ঢাকা, চট্টগ্রাম আর সিলেট মিলিয়ে ৮৭৭০ জনের মাঝে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৩৬০ জনের মাঝে ইফতার বিতরণ করা হয়েছে! কোন কর্পোরেট স্পন্সরড প্রোগ্রাম ছিল না এটা কিংবা কোন পেশাদার গোষ্ঠীর উদ্যোগও নয়; এ কাজটি সম্ভব করেছে কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী, যাদের ছিল অদম্য মনোবল আর সমাজের জন্য কিছু করার সদিচ্ছা।কিন্তু, প্রশ্ন হল-
খাবার বিতরণ করা- এটা না একটা স্বল্পমেয়াদে প্রভাব বিস্তারকারী উদ্যোগ? বিনামূল্যে খাবার বণ্টনের মত একটা গতানুগতিক কাজ কীভাবে সমাজকে বা এই প্রকল্পের সাথে জড়িত অ্যাকশনিয়ারদের জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে?
একদমই ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে পরিচালিত এই সংস্থাটির অনন্যতা এখানেই। এর অ্যাকশন: পিঁয়াজু-বেগুনীর মত কর্মসূচীও অ্যাকশনিয়ারদের এমন কিছু বিষয়ে পারদর্শী করে তোলে, যা তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলে:
- নেতৃত্বগুণের বিকাশ:
অ্যাকশন পিঁয়াজু বেগুনীর মত ছোট ছোট প্রকল্প গুলোতে অংশ নিতে গিয়েই আমাদের মধ্যের অনেকে প্রথমবারের মত নেতৃত্বের সত্যিকারের অর্থ উপলব্ধি করতে শেখে। বুঝতে শেখে যে নেতৃত্ব মানে কেবল কোন দায়িত্ব না নিয়ে শুধু আদেশ করা নয়। আমেরিকার ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি জন কুইনসি অ্যাডামস বলেছিলেন, “যদি তোমার কাজ অন্যদের আরো বেশি স্বপ্ন দেখতে, আরো বেশি শিখতে, আরো বেশি কাজ করতে আর আরো বেশি যোগ্য হতে প্রেরণা জোগায়, তবেই তুমি একজন যোগ্য পথপ্রদর্শক”।
নেতৃত্ব মানে ভালোর পথে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা, নেতৃত্ব মানে এমন সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যা হয়ত অন্যরা ভাবতেই পারে না, নেতৃত্ব মানে পুরো একটা প্রকল্পের ছোট ছোট কাজগুলোর অসাধারণ সমন্বয় করা।
অ্যাকশন পিঁয়াজু বেগুনীর সবটুকু সময় জুড়ে এলাকাভিত্তিক দলনেতা ও অ্যাকশনিয়াররা অন্যদেরকেও এই কর্মসূচীতে অংশ নিতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহ করা, দরকারি জিনিসপত্র কেনা, যাতায়াতের ব্যবস্থা করা, স্বেচ্ছাসেবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর অবদান পর্যবেক্ষণ করা, খাবার বণ্টন করা- এরকম হাজারো দায়িত্ব পালন করেছে।
এসব কাজ যেমন অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক উন্নয়নে নেতৃত্বদান বা সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে ঠিক তেমনি আর্টিকেল লিখা বা ফটোগ্রাফীর মতো সৃজনশীল কাজগুলো এবং গণমাধ্যমে এগুলোর প্রকাশের ব্যবস্থা করার মতো দায়িত্বগুলো গণমাধ্যমের সাথে সম্পর্ক গঠনে শিক্ষা দিয়েছে। এই প্রকল্পে কাজ করা আর কোন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা একই কথা, কারণ ইভেন্টটা আয়োজন করতে গিয়েই ভলান্টিয়ারদের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ক-খ-গ-ঘ শেখা হয়ে যায়!
- নারীর ক্ষমতায়ন:
সাধারণত সমাজসেবামূলক কাজগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কমই দেখা যায়। কিন্তু, কমিউনিটিঅ্যাকশন তাদের এই আয়োজনের বিভিন্ন পর্যায়ে মেয়েদের যুক্ত করে এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে। এলাকাভিত্তিক দলনেতা থেকে শুরু করে রাস্তায় খাবার বিলি করা পর্যন্ত, সব জায়গাতেই ছিল মেয়েদের উপস্থিতি! এটা সম্ভব হয়েছে কেবল স্বেচ্ছাসেবীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিউনিটিঅ্যাকশনের অবিশ্রান্ত চেষ্টায়।
এছাড়াও অবশ্য সমাজে নারীদের সক্রিয় হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কমিউনিটিঅ্যাকশনের আরো বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী (Workshop for Change-makers) রয়েছে।
- টিম স্পিরিট:
“অ্যাকশন: পিঁয়াজু বেগুনী” এর মতো টিম একশনগুলো ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ” শেখার একটা আদর্শ জায়গা। এই অ্যাকশনটি অ্যাকশনিয়ারদের দলবদ্ধভাবে কাজ করার মূল সূত্রটা বুঝতে শিখতে অশেষ সাহায্য করে। একটা দলের প্রতিটা সদস্যের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অর্থাৎ একজন ঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন না করলে যে পুরোটা কাজেই এর বিরূপ প্রভাব পড়ে– এ সম্পর্কে তাদের সচেতনতা তাদের দক্ষ আর দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে ইন্ধন যোগায়। আবার একি সাথে তারা সাফল্য আর ব্যর্থতার দায়ভার যারই হোক না কেন সকলে ভাগাভাগি করে নিতে শেখে। ভুলগুলো সবাই এক হয়ে সংশোধনের চেষ্টা করে। মতের অনৈক্য আসুক, কোন বিষয়ে সংশয় হোক; যে কোন সমস্যাই সকলে এক হয়ে সমাধানের চেষ্টা করে।
- পেশাদারিত্ব:
কিভাবে অপরিচিত বা বিপরীত লিঙ্গ কিংবা ভিন্নমত পোষণকারী কারো সাথে শোভনভাবে আচরণ করতে হয় আর একইসাথে কাজটিও আদায় করে নিতে হয়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা অর্থাৎ এক কথায় পেশাদারি মনোভাব বজায় রাখার শিক্ষাটা সবাই প্রজেক্টে কাজ করতে করতেই পায়। মানুষ সাধারণত সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা যে আসলে কত সহায়ক, এই ব্যাপারটা এ ধরণের টিম ওয়ার্কগুলো করতে গিয়েই টের পাওয়া যায়। তাছাড়া আমাদের প্রশিক্ষণই দেওয়া হয় যে কিভাবে নিজের মর্যাদা বজায় রেখে, বিচক্ষণতা আর দৃঢ়তার সাথে নিখুঁতভাবে কাজটা সম্পন্ন করা সম্ভব।
- নৈতিক মূল্যবোধ:
“সমাজ সেবা মানে রিজিউমে ভারি করা না, সমাজ সেবা মানে গর্ব করা বা উদ্ধত হওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া নয়। এটা বরং মানবতাকে বোঝার একটা সুযোগ দেয়, সুযোগ দেয় আমাদের দুর্বলতাকে বোঝার; বোঝায় অন্য অনেকের তুলনায় কত ভাল আর অনন্য জীবন যাপন সত্বেও কীভাবে আমরা “সাধারণ” হওয়ার ভান করি।”- এলুইন লোহ

“…এটা বরং মানবতাকে বোঝার একটা সুযোগ দেয়, সুযোগ দেয় আমাদের দুর্বলতাকে বোঝার; বোঝায় অন্য অনেকের তুলনায় কত ভাল আর অনন্য জীবন যাপন সত্বেও কীভাবে আমরা “সাধারণ” হওয়ার ভান করি।”- এলুইন লোহ
অ্যাকশন:পিঁয়াজু-বেগুনীতে কাজ করতে গিয়ে অংশগ্রহণকারীরা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখে। মানুষ হিসেবে আরও উন্নত হতে উদ্বুদ্ধ হয়। নানা শ্রেণী, জাতি, বয়স আর ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের সাথে মিশতে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। অনেক অংশগ্রহণকারীই স্বীকার করেছে যে, এই কর্মসূচীর মাধ্যমে দুস্থদের জন্য কাজ করতে গিয়ে তারা নিজেরা যে ব্যক্তিগত জীবনে কতো সৌভাগ্যের অধিকারী সেটা উপলব্ধি করেছে।
আধ্যাত্মিক দিক থেকে চিন্তা করলেও রামাদান মানে তো শুধু মন্দকেই পরিহার নয়, ভালকে আরো ভালো করাও বটে!
এবারের অ্যাকশন: পিঁয়াজু বেগুনীর শিক্ষা আমরা যেমন আগামী বছরেও ধরে রাখবো, তেমনি সবাইকে পরামর্শ দেব কমিউনিটি অ্যাকশনের চলমান কোন উদ্যোগে অংশ নিয়ে অবসর সময়টাকে আনন্দময় ও ফলপ্রসূ করে তুলতে।
মূল লেখাঃ মনিকা ইসলাম অনুবাদঃ আফসানা সারা কবির ও খাদিজাহ মুসলেহ
Pingback: কিছু আনন্দ, কিছু ভালোবাসা, সাথে কিছু স্বপ্ন | CommunityAction Blog