১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২। সকাল ৮টায় বের হলাম বাসা থেকে। চারপাশে তখনও হালকা কুয়াশা। কিছুক্ষণ আগেই গুরুগম্ভীর গুড়ুম গুড়ুম শব্দের কামানের আওয়াজ শুনে আর নিজ হাতে বানানো এক কাপ গরম চা খেয়ে বেশ চাঙ্গা মেজাজে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম, তাই একটু শীত শীত করলেও তার তোয়াক্কা না করে হাঁটা দিলাম মেইন রোড ধরে। গন্তব্যস্থল করাইল বস্তি। আমার এক বন্ধু ফাহিম গাড়ি নিয়ে আসল আমাকে পিক আপ করতে। আমরা দুজনেই CommunityAction এ একেবারেই নতুন, এর আগে আমার শুধু কয়েকজন আপু-ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছিল, তাও আবার Facebook এ। আর ফাহিম তো কাউকেই চিনে না, শুধুমাত্র আমার মাধ্যমে ওর এখানে আসা। পথিমধ্যে রকিব ভাইয়া কে তুলে নিয়ে মহাখালি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল সোয়া ৮টা।
বহুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর খুঁজে পেলাম করাইল নূরানী মাদ্রাসা, যেখানে আমাদের Action আয়োজন করা হয়েছে। ছোট্ট একটা টিনের চালের ঘর, ভেতরে আবছা অন্ধকার আর মশার আড্ডার মধ্যে Actioneerরা টিম লিডার সুহাইলি আপুর ব্রিফিং শুনতে ব্যস্ত। মোটামুটি ভাবে সব প্রস্তুতি নেয়া শেষ, তাই হৃদয় ভাইয়ার ইলেক্ট্রিক শক্ খাওয়া (হৃদয়ে না যদিও, হাতে) ছাড়া আর কোনো বড় ধরনের দু্র্ঘটনা ছাড়াই ইভেন্ট শুরু হল । করাইল বস্তি আর মাদ্রাসার বাচ্চারা এসে বসলে পরে ল্যাপটপে জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে শুরু হল “আকশনঃ পতাকা”। তারপর শৈশব ভাইয়ার চারটা নম্বর “৭, ২১, ২৬ আর ১৬” বাচ্চাদের দিয়ে মনে রাখানোর পর ওদের ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ দেখানো হল ’৭১ এর যুদ্ধ নিয়ে।
এর ঠিক পরপর তিথি আপু বাচ্চাদের পড়ে শুনালেন “একাত্তরের চিঠি” থেকে কিছু অংশ। সবাই রুদ্ধশ্বাসে শুনলো মুক্তিযুদ্ধের গল্প। অতঃপর নাহিদ আর শিশির ভাইয়া মজার “Ice breaking game” নিয়ে আসার আগে ঘটে গেল একটা দুঃখজনক কিন্তু eye-opening ঘটনা। শৈশব ভাইয়া সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা সবাই নিশ্চই খেলতে পছন্দ কর, তাইনা?” তো একপাশে বসে ছিল মাদ্রাসার বাচ্চারা, আর তার পাশে ছিল অন্যরা (যাদের বেশির ভাগই মেয়ে)। মাদ্রাসার বাচ্চারা সবাই উত্তর দিল, “হ্যাঁ”। শৈশব ভাইয়া বাকিদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা করনা?” এমন সময় এক মাদ্রাসার ছেলে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে গম্ভীর ভাবে বললো, “মহিলা মাইনষের খেলতে নাই…” Actioneer দের মধ্যে কেউ কেউ বিব্রত হয়ে একটু হাসলেন। আমি শুধু ছোট্ট একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলেছিলাম…
Ice breaking game এ বাচ্চারা জানলো কিভাবে চকলেট খেতে খেতে বাংলাদেশটাকে জানা যায়। ৬টি চকলেটের প্যাকেটের গায়ে সেঁটে দেয়া হল দেশের ৬টি উল্লেখযোগ্য জায়গার নাম। প্যাকেট ঘুরতে ঘুরতে যার হাতে আসবে তাকে জায়গাটির ব্যাপারে কিছু বলতে হবে। বলতে না পারলেও আমরাই ওদেরকে জায়গাটার ব্যাপারে জানিয়ে দিলাম।

এরপর আবারো এলেন শৈশব ভাইয়া। সবাইকে বললেন ‘৭১ এর পরবর্তী সময়ে পলান সরকার, জয়নাল চাচার মত যোদ্ধাদের গল্প, যাঁরা যে যার অবস্থানে থেকে দেশকে ভালবাসার মত অসংখ্য দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত…
সবশেষে কাগজ আর আঠা দিয়ে পতাকা বানানো। আবারো ওদেরকে বেশ কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে প্রত্যককে পতাকা বানাতে দেয়া হল । পতাকা বানানো শেষ হলে ওরা সবাই একসাথে যখন ক্যামেরার সামনে পতাকা নাড়াচ্ছিল, তখন আমার বার বার মনে হচ্ছিল ২০১০ সালের জনপ্রিয় গান “Wavin’ Flag” এর কয়েকটা লাইন : “When I get older, I will be stronger, They’ll call me freedom, Just like a waving flag…” ইস্, সত্যিই যদি সবাইকে স্বাধীনতা দেয়া যেতো দারিদ্র্য, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাব থেকে!
সবচাইতে ভালো লাগলো প্রথমবারের মত Actioneer দের সাথে দেখা হয়ে । আগে থেকেই ধারণা ছিলো Actioneer রা হবে “One of the most awesome bunch of people you’ll ever meet” — গিয়ে দেখলাম, আসলেই তাই! আমি প্রথমে একটু নার্ভাস ছিলাম, এত সিনিয়র আপু-ভাইয়া, সবাই আবার অনার্স-মাস্টার্স লেভের, তাদের সাথে কীভাবে যে কাজ করবো! কিন্তু সবাই এমন ভাবে আমাদেরকে treat করলেন যেন কতকাল ধরে আমরা পরিচিত! সুহাইলি আপু তো পুরনো বন্ধুদের সবাইকে ‘তুই’ করে কথা বলছিলেন, আমাদেরকেও দুই-একবার ভুলে ‘তুই’ বলে ডাকলেন, নতুন বলে আবার পরক্ষণেই শুধরে নিলেন। আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, “আপু, সমস্যা নেই, আমাদেরও ‘তুই’ বলেই ডাকেন…” পরে কি একটা কাজে ব্যস্ত হওয়াতে আর বলা হয়নি। সবার মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর সবচাইতে বেশী teamwork টা ছিল আসলেই চোখে পরার মত। সবাই মিলে একসাথে এতো সুন্দর করে কাজগুলো করলাম যে মনে হল বার্সেলোনার জাভি-ইনিয়েস্তা-মেসিও যেন আমাদের কাছে হার মানবে!!
বাচ্চারা সবাই চলে যাওয়ার আগে সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটা করে প্রাণ জুনিয়র জুস, কাস্টার্ড কেক, কলা, মোয়া, চকলেট আর Turkish Delight (Made in Bangladesh, of course!)। প্রত্যেকটা আইটেমের বেশ কিছু পরিমাণ বেঁচে থাকায় সেগুলোর পুরোটাই দিয়ে দেয়া হল বাইরের অন্যান্য বাচ্চাদের।
পরদিন কলেজে গিয়ে দেখি, সব বন্ধুরা মিলে গল্প করছে কে কি করল বিজয় দিবসে। কেউ টি.এস.সি তে, কেউ স্মৃতিসৌধে আবার কেউবা আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছে। কেউ গিয়েছে KFC তে, কেউ আবার Pizza Hut এ। আমার পালা আসলে আমি বললাম, “আমি গিয়েছিলাম করাইল বস্তিতে, বাইরে কোথাও খেতে যাইনি, তবে আপু-ভাইয়াদের সাহায্য করেছি বস্তির বাচ্চাদের খাওয়াতে…” কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা একটু কেঁপে উঠেছিলো, সামান্য ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল চোখের দৃষ্টি।
এবারের বিজয় দিবস তো গেলো যাকে বলে ফাটাফাটি। তবে আমার ধারণা, শীঘ্রই এমন একটা বিজয় দিবস আসবে যে দিবস হবে দারিদ্র্য, অনাহার, অভাব-অনটন, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের বিজয়, হয়তোবা আমাদের Actioneer দের মত কিছু স্বপ্নবিলাসী মানুষের প্রচেষ্টায়। যে দিবসে মানুষ-মানুষকে সাহায্য করবে, যার যা কিছু আছে তা দিয়েই। আর যার কিছুই নেই, সে অন্তত সবাইকে উপহার দিবে একটু মিষ্টি হাসি। যে দিবসে রাস্তা-ঘাটে চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে না আমাদের স্বাধীনতা। সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের বাহিনীর হাতে পাখির মত মরতে হবে না আমাদের সার্বভৌমত্বকে আজ না হলে কাল, কাল না হলে পরশু – একদিন না একদিন আসবেই দিনটা। আসতে যে হবেই……
শীঘ্রই এমন একটা বিজয় দিবস আসবে যে দিবস হবে দারিদ্র্য, অনাহার, অভাব-অনটন, কুসংস্কার আর শিক্ষার অভাবের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের বিজয়, সেই বিজয়ের আশায় বুক বেঁধে আছি।