প্রথমে একটা গল্প বলি,
রইসের বাবা, রসুল মিয়া কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জে একটা জিন্স প্যান্টের পাইকারী দোকানে কাজ করে। নামমাত্র বেতন পায়। রইসদের বাড়ি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। রইস কালিয়াকৈরেই থাকে। ক্লাস টু-তে পড়ে। রইস গতকাল ঢাকা যায় নি। রসূল মিয়া রইসকে নেয় নি। এবারের ক্ষেত্রটা ভিন্ন। রইসের স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। রইসের বাবা কয়েকদিনের জন্য বাড়ি আসে। ফেরার সময় রইসকে ঢাকায় নিয়ে যায়। রইসতো খুশিতে আটকানা। বিস্ময়ভরা চোখে সে চিড়িয়াখানার লম্বা ঘাড়ওয়ালা জিরাফের দিকে তাকিয়ে থাকে, শিশুপার্কের ‘মেরী গো রাউন্ডে’ চড়ার সময় খুশিতে তার চোখ বড় হয়ে আসে। জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার প্রধান ফটক গলে ঢুকলেই একটা বিশাল সাইজের ম্যাপ চোখে পড়ে। ম্যাপের পাশেই সারাদিন একজন বয়স্ক মানুষ বসে থাকে। ম্যাপে আঁকা প্রতিটা জেলার মাঝেই একটা করে ছোট বাতি লাগানো। কেউ কোন জেলার নাম বললে উনি বোতাম টেপেন। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাপের যেখানটায় ঐ জেলার অবস্থান সেই বাতিটা জ্বলে উঠে। যখন চেয়ারে বসে থাকা লোকটি বোতাম টিপতেই গাজীপুরের বাতিটা জ্বলে উঠলো, রইসের এতো আনন্দ লাগলো যে রইস একরকম চিৎকারই করে উঠলো!
তিনদিন হয়ে গেছে, আজ রইসের ফেরার পালা। রসুল মিয়া রইসকে নিয়ে আজ একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খাবে। বেশ পয়সা খরচ হবে। রসূল মিয়া ভাবলেন, ‘হলে হবে।’ সে ঐ রেস্টুরেন্টে আগে একবার খেয়েছে। তার দোকানের মালিকের ছেলের সুন্নাতে খাতনার অনুষ্ঠানে। সবাই খেয়েদেয়ে খুব দামীদামী উপহার দিচ্ছিলো। মালিক বেশ ভালো মানুষ। মালিকের ছেলেটাকে রসুল মিয়ার বেশ ভালো লাগে। রসুল মিয়াকে দেখলেই এতো সুন্দর করে আঙ্কেল ডাকে। রসূল মিয়া আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলো, ছেলেটার জন্মদিনে সে পাঁচশ টাকা দেবে। গিফট-টিফট সে কখনো কিনে নি। টাকা দেয়াই যুতসই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য টাকাটা দেয়া হয় নি। মালিক দেখতে পেয়ে, রসূল মিয়াকে কড়া করে ধমক দেয়। ভালো মানুষের ভালো মানুষীসুলভ ধমক শুনতে খারাপ লাগে না। রসূল মিয়া মাটির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
-বাবা, হাসেন ক্যান?
রইসের ডাক শুনে সম্ভিত ফিরে পায় রসূল মিয়া। সে সুন্নাতে খাতনার সেই অনুষ্ঠান থেকে বুড়িগঙ্গার কালো পানি কেটে চলা ট্রলারে ফিরে আসে। ট্রলার থেকে নেমে তারা প্রথমেই আহসান মঞ্জিলে যায়। সেখানটা ঘুরার পর কাছেই সেই রেস্টুরেন্টটায় যায় তারা। ভেতরটা দেখেই বিস্ময়ে হকচকিয়ে যায় রইস। মনেমনে বলেই উঠে, ‘এত্তো সুন্দর!’ পুরো রেস্টুরেন্টটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রসূল মিয়া আর রইস একটা টেবিলে বসে। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে যায়। রসূল মিয়া ইরানী দম বিরিয়ানি অর্ডার করে। ঐ অনুষ্ঠানে এই দম বিরয়ানীই খেয়েছিলো সে। বেহেশতেও এতো মজার খাবার পাওয়া যাবে কি-না, রসূল মিয়ার সন্দেহ আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার দুইটা পাত্র নিয়ে আসে। মাটির পাত্র অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলে মোড়া। বাসমতি চাল আর খাসির গোশতে রান্না করা এই বিশেষ বিরিয়ানি এভাবেই রান্না করা হয়। সাথে সেভেন-আপের দুইটা কাচের বোতলও ওয়েটার নিয়ে আসে।
-রইস, খাওয়া শুরু কর, বাজান।
-বাবা, উনারা কাঁটাচামুচ আর চাক্কু দিছে। এইগুলা দিয়ে কী করবো?
-এইগুলা খালি পেলেটটায় রাইখা। হাত দিয়াই খা। নানান কিসিমের মানুষ আছে। এক কিছিমের মানুষ কাঁটাচামুচ আর চাক্কু দিয়া খায়।
রইস কাঁটাচামচ আর ছুরিটা পাশের খালি পেলেটটাতে রেখে খাওয়া শুরু করে। এতো ভালো খাবার রইস তার এই দশবছরের জীবনে প্রথম খাচ্ছে। আনন্দে রইসের চোখে পানি চলে আসার উপক্রম হলো। রইস পানি আটকে রেখে হাসার চেষ্টা করলো। রেস্টুরেন্ট অনেক মানুষ, চোখে পানি দেখলে মানুষ কি যে ভাববে।
রইসের বাবার খাওায়া শেষ। সে এখন সালাতের প্লেটে অবশিষ্ট শসার টুকরাটা খাচ্ছে। সে হঠাৎই বলে উঠলো, ‘রইস তাড়াতাড়ি খা। তোর খাওয়া দেহি আগায়ই না। তাড়াতাড়ি খা…’
রইস তার বাবার কথা শুনে হাসলো। কেবল রইস আর স্রষ্টাই জানে, কেন সে এতো ধীরে-ধীরে খাচ্ছে। সে চাইছিলো না, তার এতো আনন্দের সময়টা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক। রইস খাসীর টুকরাটায় ছোট করে একটা কামড় দিলো। আনন্দে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তবে এই চোখ বন্ধ করা হয়তো রইসের চোখের পানি লুকোনোরই একটা চেষ্টা।
গল্প শেষ। মেহেন্দি ম্যাজিক নিয়ে লেখায় গল্পের অনাহূত প্রবেশ কেন কিংবা মেহেন্দি ম্যাজিকের সাথে সাথে এই গল্পের সম্পর্কটা কি, এমন প্রশ্ন পাঠকের মস্তিষ্কে অনুরণিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি হয়তো নিজেও জানি না, প্রকৃত সম্পর্কটা কি। লিখতে লিখতে শেষান্তে পৌছে গেলে হয়তো জানা যাবে। দেখা যাক…
কমিউনিটি অ্যাকশনের সাথে আমার সংযুক্তি গতবছর, অ্যাকশন পেঁয়াজু-বেগুনীর মাধ্যমে। দুইটা জোনের মেহেন্দি ম্যাজিকেও ছিলাম। কমিউনিটি অ্যাকশনের ইভেন্টগুলোতে একবার কাজ করলে সময়চক্রায়নে আবার যখন সেগুলো ফিরে আসে, আকশনিয়াররা নিতান্তই অপারগ (ব্যস্ততা সহ অন্য কোন সমস্যা) না হলে, সেগুলো মিস করেন না। কেন মিস করেন না অথবা করতে চান না- তার কারণ কেবল আকশনিয়াররাই জানেন। একবার একটা কাজের সাথে অন্তর্ভুক্তি, অদ্ভুত একটা নেশার সৃষ্টি করে। সেই নেশাই পরের ইভেন্টগুলোতে কাজ করার জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ভালো কিছু করার এক অদ্ভুত নেশা সহজাতভাবেই গড়ে উঠে।
এ’বছর কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে মেহেন্দি ম্যাজিক-২০১৫ অনুষ্ঠিত হয়। আমি হলেই ছিলাম। ঠিক করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর খিলগাঁও জোনে কাজ করবো। খিলগাঁও জোনে অংশগ্রহণ নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিলাম কারণ তার একদিন পরই পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করা ছিলো আগে থেকেই। তবে আলহামদুলিল্লাহ শেষ পর্যন্ত থাকতে পেরেছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জোনে আর খিলগাঁও জোনে ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনাগুলোর খুব সংক্ষেপে লিখলেও লেখাটা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কায় আমি ব্যতিবস্ত না হলেও কিছুটা চিন্তিততো বটেই!:P তাছাড়া সিএ’র (কমিউনিটি অ্যাকশন) ফেইসবুক পেইজে ইভেন্ট শেষে জোনাল লিডাররা বেশ ঘুছিয়ে তার একটা সারসংক্ষেপ লিখেছেন।
দু’বছরে আমি মেহেন্দি ম্যাজিকের পাঁচটা জোনে কাজ করেছি। নিঃসন্দেহে সবগুলোই অসাধারণ ছিলো। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এর মধ্য কোন জোনে কাজ করা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে? আমি নির্দ্বিধায় গতবছর মোহম্মদপুর জোনের মেহেন্দি মাজিকের কথা বলবো। রমজান মাস, বেড়িবাঁধের পাশের একটা মাঠে প্রচণ্ড রোদে বালুতে কাজ করার জন্যই শুধু না, অনুমানের চাইতে অনেক বেশি শিশুর উপস্থিতিই বোধয় আর অনুমানের চাইতে কম আকশনিয়ারের উপস্থিতিই হয়তো তার কারণ। তাছাড়া এটাই ছিলো আমার প্রথম কোন মেহেন্দি ম্যাজিকে কাজ করা। শেষের দিকে গিফটের প্যাকেট দেয়া একটু বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশীয় প্রেক্ষাপটে আমাকে দীর্ঘকায় মানুষ বলা যায়। গিফটের প্যাকেটগুলো আমি হাতে করে উপরে তুলে রেখেছিলাম, এই ছোটছোট বাচ্চারা প্রায় আটফিট উঁচু থেকে কিভাবে পেরে আনলো তা কেবল ওখানে স্বয়ং উপস্থিত থাকলেই বোঝা সম্ভব! (আসলে বাচ্চারা পাঞ্জাবী ধরে টানাটানি করায়, আমার পক্ষে আর আটফিটের উচ্চতা বজায় রাখা সম্ভব হয় নি :P ) সাদা পাঞ্জাবীতে মেহেন্দির ছোপছোপ ডিজাইন নিয়ে আমি বাসায় ফিরি। পাঞ্জাবীটা আমার খাটের নিচের ট্রাঙ্কে এখনো আছে।:D তবে আম্মু কিভাবে যেন দাগগুলো তুলে ফেলেছিলেন (এইক্ষেত্রে কি ইমোটিকন দেয়া উচিত, জানি না। কনফিউজড!)
আর যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মেহেন্দি ম্যাজিকের কোন জোনের ইভেন্ট মনে বিশেষ দাগ কেটেছে? তাহলে বলবো, এবছরের খিলগাঁও জোন। শুধুমাত্র ২০শে অক্টোবর প্রায় সারাদিন থেমে থেমে আকাশ তার মন খারাপ উদযাপন করেছিলো সেজন্য নয়। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, কোরবানির হাট মাড়িয়ে ইভেন্ট লোকেশনে যাওয়া, সবমিলিয়ে প্রকৃতির বিমাতাসুলভ আচরণের জন্যও নয়, অন্য একটা কারণে। সেই কারণ, সেই অনুভূতি লিখতেই আমাদের এখন পর্যন্ত এতো লম্বা ভূমিকা লিখা। আমি গল্পের রইসের মত আস্তে আস্তে এগিয়েছি।
মেহেদি লাগানোর পর বাচ্চাদের জন্য আমরা সামান্য গিফটের ব্যবস্থা করেছিলাম। খুব সামান্য- একটা করে শ্যাম্পু, বেলুন, ক্যান্ডি আর ছোট কাসটার্ড কেকের প্যাকেট। একটা পর্যায়ে আমাদের কেক যখন শেষ হয়ে যায়, তখন যে বাচ্চারা এসেছিলো তাদের কেকের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে চারটা করে ক্যান্ডি দেই। আমি নিজেও শেষে মেহেদীর টিউব নিয়ে বাচ্চাদের হাতে ওদের নাম আঁকছিলাম। নখকাঁটা ব্যতিরেকে আমি কেবল ওটাই পারি কি-না।:P একজন বাচ্চা আমার সামনে এসে আমার মেহেদি দেয়া দেখছিলো, সে হঠাত বলে উঠে, ‘আঙ্কেল, আপনেরা খাওয়োন (কেক) দিবেন?’ আমি তখন ওকে বলি যে, কেক শেষ। পরবর্তীতে ওকে বোধয় চারটা ক্যান্ডি দেয়া হয়েছিলো।
পাঠক কি উপরের দুই লাইনের মধ্যে বিশেষ কোন গন্ধ পেয়েছেন? পাঠকের কাতারে বসে আমি কেবল লাইনগুলো পড়লে, আমিও বোধয় তেমন গন্ধ পেতাম না। এমনটা না, পকেটে টাকা থাকলেও (সত্যি বলতে, ছিলো না) বাচ্চার কথা শুনে আমি তখন বিশেষ কোন ‘মন খারাপীয়’ ভাবনায় দ্যোতিত হয়েছি কিংবা অনুভব করেছি, একটা কেক এনে বাচ্চাটাকে দেই। প্রকৃতপক্ষে ইভেন্টের মাঝামাঝিতে আমি পাশের একটা টঙ দোকানে গিয়েছিলাম আমার ট্রাউজারে লেগে যাওয়া মেহেদি ধুতে। আমাদের অনুভূতি, ভালো মানসিকতাও বাস্তবার নিরিখে আবর্তিত হয়। সেই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক বাস্তবসম্মত কাজটিই হয়তো করেছে, একটা চিন্তা উপেক্ষা করে বিকল্প পথ খুঁজেছে। (কাসটার্ড কেকের রিপ্লেসমেন্টে বাড়তি ক্যান্ডি দেয়া) কিন্তু একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, চট করেই সবকিছু সব অনুভূতি উপেক্ষা করতে পারেন না। আমিও পারি নি, তাই লিখতে বসা।
‘খাওয়োন’ ব্যাপারটা একাকার হয়ে গেছে গল্পের রইছ থেকে মেহেন্দি ম্যাজিকে আসা শিশুটির মধ্যে।
দিনশেষে বাচ্চারা হেসেছে, আমরা হেসেছি, স্রষ্টাও হয়তো হেসেছেন- প্রাপ্তির ঝুলি পূর্ণ করতে আর কি কিছুর দরকার আছে? :)